@laravelPWA
মহান আল্লাহ নিজেই ইমাম হোসাইনের রক্তের বদলা নেবেন
  • শিরোনাম: মহান আল্লাহ নিজেই ইমাম হোসাইনের রক্তের বদলা নেবেন
  • উৎস:
  • মুক্তির তারিখ: 19:19:49 8-6-1404

 ثار শব্দটি ثأر অথবা ثؤرة শব্দ মূল থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে প্রতিশোধ,রক্তের বদলা,রক্তপণ; রক্ত অর্থেও তা ব্যবহৃত হয়।(মাজমাউল বাহরাইন, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৩৭; মুঈন, মোহাম্মাদ, ফারসি অভিধান, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৮৫; মুফরাদাতে রাগেব, পৃ. ৮১)

১. ثارالله শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে যার প্রতিটিরই আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে,যেগুলোর সামগ্রিক অর্থ হলো যে,আল্লাহ্ তা‘আলা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্তের অভিভাবক এবং তিনি নিজেই শত্রুদের থেকে এই মহান ব্যক্তির রক্তের বদলা নিতে চান। কেননা,কারবালায় সাইয়্যেদুশ শুহাদার রক্ত ঝরানো মহান আল্লাহর নিষিদ্ধের সীমা লঙ্ঘন,তাঁর সম্মান বিনষ্ট করা এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার শামিল। সর্বোপরি আহলে বাইত (আ.) হচ্ছেন ‘আলুল্লাহ্’ অর্থাৎ আল্লাহর মনোনীত ও বিশেষজন; এই ইমামদের রক্ত ঝরানোর অর্থ আল্লাহ তা‘আলার কাছে সম্মানিত ও তাঁর প্রিয়তম ব্যক্তিদের রক্ত ঝরানো।(মুহাদ্দেছি, জাওয়াদ, দারস্হাঈ আজ যিয়ারতে আশুরা, পৃ. ১৪; আজিজি তেহরানি, আসগার; শারহে যিয়ারতে আশুরা পৃ. ৩৫।)

যদিও এ শব্দটি পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত হয়নি,কিন্তু কোরআনের আয়াতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যে,আল্লাহ্ বলেছেন

) وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا(

অর্থাৎ যে অন্যায়ভাবে নিহত হয় নিশ্চয় আমরা তার উত্তরাধিকারীকে (প্রতিশোধ গ্রহণের) অধিকার দান করেছি। (সূরা বনি ইসরাঈল : ৩৩)

যদি কেউ (যে কোন ধর্মের অনুসারী হোক) অন্যায় ও মযলুমভাবে নিহত হয় তাহলে তার অভিভাবকরা তার রক্তপণ আদায়ের অধিকার রাখে। যেহেতু আহলে বাইতের ইমামগণ বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.) সত্য,ন্যায় এবং আল্লাহর পথে অসহায় ও মযলুমভাবে শহীদ হয়েছেন,সেহেতু আল্লাহ নিজেই তাঁর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী। কেননা,স্বয়ং আল্লাহ্ই ইমাম হোসাইনের রক্তের উত্তরাধিকারী।

এই কারণে ثأرالله এই অর্থে ব্যবহৃত হয় যে,ইমাম হোসাইনের রক্ত আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত এবং তিনি নিজেই ইমাম হোসাইনের রক্তের বদলা নেবেন। এই শব্দটা আল্লাহর সাথে সাইয়্যেদুশ শুহাদার সুদৃঢ় বন্ধনের প্রতি ইঙ্গিত করে যে,তাঁকে হত্যার মাধ্যমে যেন আল্লাহ তা‘আলার সাথে সম্পৃক্ত ও তাঁর সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত এক ব্যক্তির রক্ত ঝরানো হয়েছে। ফলে তাঁর রক্তের প্রতিশোধ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গ্রহণ করলে হবে না।(ثأرالله ফারহাঙ্গে আশুরা)

২. যদি ثار শব্দটির অর্থ রক্ত হয়,তাহলে অবশ্যই ثار الله শব্দটি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি; বরং তা উপমা হিসেবে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা,এ বিষয়টি সুনিশ্চিত যে,আল্লাহ কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নন যে,তাঁর শরীর অথবা রক্ত থাকবে। অতএব,এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর উপমা দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়কে বুঝানো হয়েছে,যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের ভূমিকা অর্থাৎ জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা। আল্লাহর দ্বীনের সাথে ইমাম হোসাইনের সম্পর্কও ঠিক সেরকম। আশুরা বিপ্লবই ইসলামকে পুনরায় জীবনদান করেছে।

৩. সম্ভবত এই ব্যাপারটিকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমরা বিভিন্ন রেওয়ায়াতের দলিলের ভিত্তিতে একটি ভালো ফলাফলে পৌঁছতে পারি। আলী (আ.)-কেও ‘আসাদুল্লাহ’ (আল্লাহর সিংহ) বা ‘ইয়াদুল্লাহ’ (আল্লাহর হাত) বলা হয়েছে। ‘হাদীসে কুরবে নাওয়াফেল’ (নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ সংক্রান্ত হাদীস)-এ মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে,আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন : ‘আমার বান্দা ওয়াজিবসমূহের থেকে অধিক পছন্দনীয় কিছু দ্বারা আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে না,তদ্রূপ নফল দ্বারাও আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। তখন আমিও তাকে ভালোবাসি আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি তখন আমি তার কান হয়ে যাই,যা দ্বারা সে শ্রবণ করে এবং আমি তার চোখ হয়ে যাই,যা দ্বারা সে দেখে,আমি তার জিহ্বা হয়ে যাই,যা দ্বারা সে কথা বলে,আমি তার হাত হয়ে যাই,যা দ্বারা সে ধরে,আমি তার পা হয়ে যাই,যা দ্বারা সে পথ চলে; যদি সে আমার দরবারে দোয়া করে আমি তা পছন্দ করি এবং যদি আমার কাছে কিছু চায় তবে তাকে তা দান করি।(আল-মাহাসেন, বারকি, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৯১)

এই রেওয়ায়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে,আল্লাহর ওলীরা হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি এবং আল্লাহর স্পষ্ট দলিল হিসেবে তাঁর কর্মের প্রকাশকারী। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার সেহেতু তাঁর দেহ নেই,কিন্তু তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। তাঁর ওলীদের মাধ্যমেই নিজের গুণাবলির প্রকাশ ঘটান এবং যখন তাঁর কোন বান্দাকে সাহায্য করতে চান তখন তাঁদের মাধ্যমেই তা করেন এবং ধর্মকে বাঁচানোর জন্য যে রক্ত তিনি ঝরাতে চান তা তাঁর ওলীদের শাহাদাতের মাধ্যমেই ঝরান। ঠিক যেভাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় তাঁর হাতকে সবার হাতের ওপর আল্লাহর কুদরাতী হাতের (ইয়াদুল্লাহ) নমুনাস্বরূপ রেখেছিলেন এবং মহান আল্লাহ তখন এ আয়াত يَدُ اللَّـهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ অবতীর্ণ করেন,তেমনি ইমাম হোসাইনের রক্তও ‘আল্লাহর রক্ত’ (ثارالله) হিসেবে গণ্য হয়েছে। যিয়ারতে আশুরায় আমরা পড়ি :

السلام علیك یا ثار الله و ابن ثاره و الوتر الموتور

অর্থাৎ ‘হে আল্লাহর রক্ত,তাঁর রক্তের সন্তান,তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে নিঃসঙ্গ একাকী!’ তেমনিভাবে মরহুম ইবনে কুলাভেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ১৭ এবং ২৩ নং যিয়ারতে এভাবে বর্ণনা করেছেন :

انک ثارالله فی الارض والدم الذی لا یدرک ترته احد من اهل الارض ولا یدرکه الا الله وحده

যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের জীবনসঞ্চারী ভূমিকা রয়েছে এবং রক্ত থাকা বা না থাকার ওপর তার জীবন ও মৃত্যু নির্ভর করে,ইমাম আলী ও ইমাম হোসাইনের উপস্থিতি আল্লাহর নিকট তাঁর ধর্মের জন্য তেমন ভূমিকা রাখে। যদি হযরত আলী (আ.) না থাকতেন তাহলে বদর,উহুদ,খায়বার ও খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হতো এবং ইসলাম টিকে থাকত না; আর যদি ইমাম হোসাইন (আ.) না থাকতেন তাহলে ইসলামের কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। কেননা,আল্লাহ তাঁর মনোনীত বান্দাদের-যখন তাঁরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য আত্মোৎসর্গী ভূমিকা রাখেন-প্রতি তাঁর ঐশী সাহায্য প্রেরণ করার মাধ্যমেই সকল যুগে তাঁর ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন।

হ্যাঁ,যতদিন ইমাম হোসাইনের স্মৃতি জগরুক থাকবে,তাঁর নাম মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হবে,হোসাইনপ্রীতি মানুষের অন্তরে অন্তরে স্পন্দিত হবে,তাঁর বেলায়াত ও প্রেমের শিখা মানুষের হৃদয়ে প্রজ্বলিত থাকবে,‘ইয়া হোসাইন’ আহাজারি আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে ততদিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর নাম টিকে থাকবে। কেননা,তিনি তাঁর সর্বস্ব আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছেন,উৎসর্গ করেছেন। সত্যকে বিচ্যুতকারী মুনাফিকদের কুৎসিত চেহারা থেকে মুখোশ খুলে দিয়েছেন এবং মহানবীর খাঁটি ও প্রকৃত ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। আর তাই তাঁর রক্ত আল্লাহর রক্তের মর্যাদা পেয়েছে।

(আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর গ্রন্থ থেকে সংকলিত)